জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১২

এলে বেলে

এলে বেলে



কাল রাত থেকে মনটা খুউব অস্থির আর বিষণ্ণ হয়ে আছে।
গত জানুয়ারিতে সৌদি আসার পর থেকে যা কিছু দেখছি জানছি তা কখনোই হতো না এখানে না এলে।
মার্চ থেকে চলছে প্রচণ্ড দাবদাহ ; তাপমাত্রা মধ্য জুন-জুলাইতে এসে ৫০ ডিগ্রি সে. ছাড়িয়ে যায়। এখনও দিনের তাপমাত্রা ৪০-৪৫ ডিগ্রি সে. ছুঁয়ে যাচ্ছে।
রোযায় ক্লান্ত পিপাসায় ছাতি ফাটে দিনভর।
দিনের বেলায় ঘর থেকে বের হতে একেবারে ইচ্ছে করে না।
খেটে খওয়া শ্রমিকের, মজুরের কথা ভাবলে খারাপ লাগে।
সোনার হরিণের সন্ধানে ভিটে-মাটি বেঁচে প্রিয়জন ছেড়ে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কি দুঃসহ ধুঁকে ধুঁকে মরা!
নদী নেই, খাল নেই, সবুজ বনানী নেই।
চারদিক কি বিষণ্ণ, রুক্ষ আর ধূসর!

সন্ধ্যা হলে আলোকসজ্জায় সাজে গোটা নগরী। কার সাধ্য আঁচ করে সুদৃশ্য বহুতল এসব ইমারতের পেছনে কতো শ্রমিকের জীবন স্বপ্ন ঝরে গেছে।
বিশাল সব সড়ক দিয়ে সারি সারি গাড়ি ছুটে চলে দিনরাত।
প্রাকৃতিক সম্পদ পেট্রোলিয়াম এদের দিয়েছে আকাশছোঁয়া আভিজাত্য, নিশ্চিন্ত জীবন।
পতঙ্গের ন্যায় ছুটে আসা সকল স্বপ্ন ঝলসে যাচ্ছে মরুর তপ্ত বালুকা রাশিতে।
গরমে এখানে বালু ঝড় ওঠে ; ঠিক আমাদের যেমন কাল-বোশেখী!
দিনের বেলায় গাড়ি চলে হেড-লাইট জ্বেলে।
সবাই ব্যস্ত, দু-দণ্ড দাঁড়াবার সময় কারো নেই।

দিন রাত অস্থির ভোঁ-ভোঁ এসির শব্দে মনে হয় এখনও মরিনি, বেঁচেই আছি।
অফিস আদালত সবই চলে যে যার মতো করে সময় বাঁচিয়ে।
সপ্তাহে বাঁচে একটি দিন। সবার মুখে হাসি।
কাচকি মাছের চচ্চড়ি হবে, ইলিশ মাছের দো-পেঁয়াজি।
পটল, কাঁকরোল, কচুর লতি।
দিনভর টিভি চলে, চলে হাসিনা-খালেদা, দেশের কথা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক অবিরাম।
সবাই পণ্ডিত, সবাই জানে সব কিছু , ভাবখানা অতি হামবড়া!
কেউ বলে চ্যানেল-আই, কেউ বলে এন-টিভি, কেউবা আবার দেশ টিভি।
তর্ক থামে না গুষ্ঠি নিপাত তারেক-জয়-হাসিনা-খালেদা-এরশাদ-নিজামীর!

বিশ্বাস হতো না এদের সাথে না মিশে মুখ ভার করে থাকলে ।
তর্ক থামে না, খানা-পিনা চলে চায়ের কাপে ঝড়, কার বৌ ভেগে গেছে, কার মেয়ে কোথায় আছে।
এত সবের মাঝেও কোথায় যেন ছন্দপতন, সুর কাটা-ছেঁড়া।
সকালে, খুউব সকালে কাক-ডাকা ভোরে কাজে যেতে হবে, কথা নাই ঘুমাও চুপটি করে।
খেটে খাওয়া সাধারণের সাথে তোমরা কখনো মেলামেশা করনি। কখনো নাওনি তাদের আপন করে ।
বড় বড় কথা বলো, বড় বুলি মুখে এদের ভোটে ক্ষমতায় আসো যাও এদেরই রক্ত শুষে।

কথা শুনি তাদের, ভালো লাগে দেশের প্রতি তাদের আন্তরিক দরদ দেখে।
কাল রাত ২টায় অফিসে কেউ নক করলো। দরজা খুলে দেখি আমাদের লজিস্টিকস আর মেইনটেনেন্স এর ফোরম্যান দাঁড়িয়ে।
কী হয়েছে?
বলল,'দুর্ঘটনা ঘটে গেছে স্যার, তাড়াতাড়ি আসেন হসপিটাল যেতে হবে।'
বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো।
আমাদের মাইনিং ডিভিশনের রয়েছে হেভি মেশিনারির বিশাল ডিপো।
ক্রেন, বুল-ডোজার, রোড পেভিং, ড্রিবলিঙসহ নানা ভারি মেশিনারি নষ্ট বা অকেজো হলে মেইনটেনেন্স এর ওয়ার্কশপে আনা হয়।

রোযার মাসে রাত ৯টা থেকে ভোর ৩টা পর্যন্ত কাজ চলে সেখানে।
দ্রুত ছুটে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম তাতেই আমার হৃৎ-কম্পন থেমে যাবার দশা।
দাউদকান্দির একটা ছেলে। বয়স ৩৭/৩৮ হবে। হেল্পার। দেখলাম তার নাকমুখ ভেসে যাচ্ছে তাজা রক্তে।
তুলো দিয়ে চেপে ধরা হয়েছে। রক্ত থামছে না।
কাজ করার সময় বিশাল এক বোল্টের গুঁতো খেয়েছে দু ভ্রু’র মাঝখানে।
দিশেহারার ন্যায় গাড়ি ছুটিয়ে ক্লিনিক এ ছুটলাম। রাত প্রায় ৩ টা বাজে। সব ডাক্তার চলে গেছেন সেহেরী খেতে।
আবার ছুটলাম বাতহা নামক ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত একটি এলাকায়। সেখানে বাংলাদেশী ও ইন্ডিয়ান ডাক্তার থাকেন।
যেতে যেতে তার কথা শুনলাম।
দেশে বাবা পঙ্গু হয়ে বিছানায়, বিবাহযোগ্যা তিনটি বোন, বৌ এবং চার ছেলেমেয়ে।
এক ভাই কুমিল্লা পলিটেকনিকে পড়ে।
নিজেদের সামান্য কৃষি জমি আছে। তাতে ফসল করতে সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ, মজুরের টাকা হিসেব করলে কিছুই থাকে না।

বাংলাদেশী টাকায় তার বেতন ১৮ হাজার। নিজে অনেক কষ্টে চলে বাড়িতে ১৪/১৫ হাজার টাকা পাঠাতে পারে। এদিয়ে এতগুলো মুখে ডাল-ভাত হয়তো জোটে ;
কিন্তু বাবার ওষুধ, বোনের বিয়ে, ভায়ের পড়ার খরচের যোগান দেয়া যায় না।
নিজের ছেলেমেয়েদের 'বেরাক স্কুলে' দিয়েছে। পড়াশোনা হয় না।
বলে আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছে। তিন মেয়ের পর একটি ছেলে হয়েছে।
তার বয়স এখন তিন। মুখ দেখতে পারেনি।
স্যার চলে আসার পর আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করেছি একটি ছেলে চেয়ে।
আমি বলি, 'আরে মিয়া! তিনটি মেয়ে আল্লাহ তোমায় দিয়েছে, তাদেরই শু-শিক্ষা দিতে পারছো না আবার ছেলে কেন?
এদের ভরণ-পোষণ লালন-পালন করতে পারছো না, আর ছেলেমেয়েতে তফাৎ টা কী ?'

সে একটু উত্তেজিত হয়ে বললো,'স্যার বেয়াদপি মাফ। খাওয়া পড়ার মালিক আল্লাহ্, উনি দিয়েছেন উনিই খাওয়াবেন, আমি অসিলা মাত্র।'
বললাম, 'বুঝলাম, তুমি পরিবার পরিকল্পনার কথা শুন নাই? মাঠকর্মীরা তোমাদের গাঁয়ে যায় না? তারা কি বলে না নারী পুরুষ সব সমান সমান?'
আমার কথা শেষ হবার আগে সে বললো, 'স্যার ওসব বুজরুকি। এরা ফিরি(Free) যা দেয় ওসব খেয়ে আমার পরিবার একবার মাথা ঘুরা, বমি বমি ভাব নিয়া যায় যায় অবস্হা।
আরেকটা কথা নারী পুরুষ সমান হবে কি করে!
আপনি একটা নারিকেল গাছের চূড়ায় অনায়াসে উঠতে পারবেন। কিন্তু একজন মহিলা কি তা পারবে ?'
তাকে নানান যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চাইলাম নারী পুরুষ সমান।
সে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলল, 'সমান যদি হয় তবে আমার বোনগুলার বিয়ে হয় না ক্যান! ক্যান যৌতুক চায় ? আমার বোনের কি একটা পাও, একটা চোখ কানা নাকি!
আমি ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
তার কপাল বেয়ে আবারও রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে শুরু করেছে। আমি তার কাঁধে সান্ত্বনার হাত রাখি।
সে ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমার চোখের কোণে কী যেন চিক্ চিক্ করছে!

(২৭শে অক্টোবর ,২০১০)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন