জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১২

নারী অধিকার বনাম অনগ্রসর জনপদ

নারী অধিকার বনাম অনগ্রসর জনপদ


ছাত্রজীবনে আমি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরেছি। সময় ও সুযোগ পেলে এখনো ছুটি-ছাটায় দেশে গেলে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে হারিয়ে যাই। গাঁয়ের সঙ্গে আমার হৃদয়ের একটা বন্ধন বহু বছর থেকে। আমি জন্মেছি ও বড় হয়েছি ঢাকা শহরে আর তাই হয়ত শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে শান্ত,ছায়া ঘেরা গাঁ আমায় সদা হাতছানি দিয়ে ডাকে। কোথাও গেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারপাশ লক্ষ্য করি। এটা আমার অভ্যাস বা বদভ্যাস বলতে পারেন।

আমি বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের যে ছবি দেখেছি তাতে উপলব্ধি করেছি যে অশিক্ষা, কুসংস্কার, অজ্ঞতা এখনো বিদ্যমান, নারী স্বাধীনতা বা নারী অধিকার লঙ্ঘন আর নারীর প্রতি বৈষম্যের যে চিত্র দেখা যায়, তা আধুনিক শহুরে জীবন আর কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না; মেলাতে পারি না।

একটা পরিবারে পরপর ৩-৪ জন কন্যা সন্তান জন্মাবার পরেও যখন ছেলে সন্তান লাভে ব্যর্থ হয়, তখন ওই মায়ের ওপরে কি পরিমাণ লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নেমে আসে, তা শহরে বসে কল্পনা করা যায় না। আর কয়েকটি মেয়ে সন্তানের পর যদি একটি ছেলে সন্তান জন্মায়, তখন মা-বাবা,দাদা-দাদির আনন্দের সীমা থাকে না... যাক! অন্তত: বংশের প্রদীপ রক্ষা পেল।
মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়াকে এখনো গ্রামের সমাজে বোঝা মনে করা হয়।
এর নানাবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম বোধহয় একজন সাধারণ কৃষক কিংবা দরিদ্র বাবা তার বাড়ন্ত কন্যাটিকে পর্যাপ্ত শিক্ষা, খাবার কিংবা আব্রু রক্ষার মত পর্যাপ্ত বস্ত্র দিতে পারেন না। বাবা-মায়ের মনে কেবলই ভয়, কেবলই দুশ্চিন্তা; এই বুঝি সমাজের দুষ্ট ক্ষতগুলো তার বেড়ে উঠতে থাকা মেয়েটির দিকে কূ-দৃষ্টি দেয়, তাকে নিয়ে মেতে ওঠে পাশবিকতায়। আর তাই কন্যা সন্তানের সম্মান রক্ষা করতে তারা বাল্যবিবাহের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
এ ক্ষেত্রেও অসঙ্গতিগুলো প্রকট। দেখা গেল, বর একজন বয়োবৃদ্ধ, পূর্ব-বিবাহিত কিংবা তালাক-প্রাপ্ত পুরুষ।
এই বাল্যবিবাহে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটি অন্যান্য ভাবে নিগৃহীত হবার সঙ্গে সঙ্গে অমানবিক যৌন অত্যাচারের শিকার হচ্ছে।

আমি দেখেছি, মা তার কন্যা সন্তানদের উপেক্ষা করে ভালো ভালো সব খাবার, মাছের মুড়োটা, মাংসের বড় টুকরোগুলি তুলে দেয় ছেলের পাতে। ছেলের জন্য মায়ের চোখে সব সময়ই প্রশয় আর সঠিক শাসনের অভাব। বোনগুলোও দেখে দেখে শিখে যায় যে এই সংসারে তারা অপাংক্তেয়,ভাইয়ের স্থান তাদের অনেক ওপরে। তারা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা।কিন্তু তারা তো প্রত্যক্ষভাবে অবহেলার শিকার-ই হচ্ছে। তারাও ভাইকে প্রশ্রয় দিতে শেখে। তারা প্রতিনিয়ত হীনমন্যতায় ভোগে,অস্বাভাবিকতা নিয়ে বড় হয়ে যখন নিজের সংসারে প্রবেশ করে, সেখানেও এর প্রতিফলন ঘটে, সেখানে পুত্র সন্তানের প্রতি তারা নিজেরাও এমনই পক্ষপাতমূলক আচরণ করে।

এই পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর প্রতি এই বৈষম্য মূলক আচরণ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

(নারী আন্দোলনের পথিকৃত্ বেগম রোকেয়া)



যৌতুকের অভাবে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কাছে নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকারের মত বিষয়গুলি একেবারেই অর্থহীন।

ঘুণে ধরা এই সমাজে নারীকে স্বাবলম্বী করতে হলে, তাদের আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হলে চাই নারীর প্রতি সম্মান, শিক্ষা... সুশিক্ষা, “নিরক্ষরতা দূর করা নয়”। শিক্ষার হার বেড়েছে, এটা আমি আপনি সবাই বলি। কিন্তু সফলতার হিসেব নিয়ে বসলে কি দেখা যায়? দারিদ্রসীমার নীচে যে পরিবারটি বাস করে, তার কন্যা সন্তানটি হয়ত কোনো NGO বা সরকারী স্কুলে যায় যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার সরঞ্জাম বা শিক্ষার পরিবেশ কিছুই নেই। আর আমরা সেসব স্কুলে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের পরিসংখ্যান নিয়ে শিক্ষার হার বাড়ছে বলে উল্লসিত হই!

আমরা এটা ভাবি না যে একজন কন্যা সন্তানকে প্রতিদিন ঘরের ও সংসারের কত কাজ করতে হয়। যে সময় তার পড়তে বসার কথা, তখন হয়তো বিদ্যুৎ থাকে না নয় কেরোসিনের অভাবে ঘরে পিদীম জ্বলেনা। তার শিক্ষার উপকরণ, যেমন বই,খাতা,পেন্সিল ইত্যাদি কেনার সামর্থ্য দরিদ্র পিতার নেই।

(এদের বাদ দিয়ে কোন উন্নয়ন সম্ভব নয়।)


পরিশেষে একটি কথা, আমরা সুশিক্ষিত সচেতন একটি জাতি চাই। আমরা চাই মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ব বিকশিত হোক। সকল শোষন, বঞ্চনা আর বৈষম্যের অবসান হোক। নারীকে সমাজের বোঝা মনে করা না হোক...তাহলে হয়তো আমাদের আইন করে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে না।

ছবি:ইন্টারনেট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন