জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১২

ইফতার পার্টি,সোনার তলোয়ার সমাচার

ইফতার পার্টি,সোনার তলোয়ার সমাচার



আমার এক বন্ধু রিয়াদে একটা হাসপাতালের ডাক্তার।
একসময় সিএমএইচ এ ছিলেন।
অবসর নিয়ে চলে এসেছেন এখানে। তাঁর অনেক যশ, সুনাম চারদিকে।
কারণ একটাই, উনি গরিব আর অসহায় রোগীদের আর্থিক, ব্যক্তিগত ও নানা রকম সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে থাকেন।
আর এটা করে তিনি কোনো প্রচার চান না।অনেকটা নিভৃতে চলছে তার পরোপকার।

আমি সময় সুযোগ পেলে তাঁর কাছে ছুটে যাই।দুজন মেতে উঠি নানান আলোচনায়।
চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমার আগ্রহ দেখে বললেন,দেখেন ভাই এদেশে স্বাস্থ্য-বীমা ছাড়া চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
ঔষধ, প্যাথলজি পরীক্ষা এতো বেশি ব্যয়বহুল আমি ভাবতেই পারি না যে সৌদিআরব প্রবাসী বাংলাদেশীরা অসুস্থ হয়ে পড়লে কোত্থেকে এই খরচ বহন করবে।
আমার কাছে সব ধরনের রোগী-ই আসে ; কিন্তু একবার ভাবুন, একজন দিন মজুর, নির্মাণ-শ্রমিক বৈধ/অবৈধভাবে থাকছে, কাজ করছে, দুর্ঘটনা তো দৈব-পাকে ঘটে-ই থাকে।
বৈধ আবাসিক আই.ডি বা “আকামা” ছাড়া, স্বাস্থ্য-বীমা ছাড়া এরা কোনো ধরনের চিকিৎসা পাবে না।
অনেক সময় দেখা যায় সামান্য গ্যাস্ট্রিক-আলসার হলেও এরা দেশে চলে যায় চিকিৎসা নিতে।
আর না হয় দেশ থেকে ওষুধ যেমন ব্যথানাশক,এন্টিবায়োটিক,ওমেপ্রাজল কিম্বা রেনিটিডিন আনিয়ে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই খেয়ে যায় দিনের পর দিন।
এসব ঔষধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া যে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে সেটা তারা চিন্তাও করে না।
সবচেয়ে বেশি যে সমস্ত দৈহিক অভিযোগ নিয়ে এরা হাসপাতালে আসে তার মধ্যে এসিডিটি, গ্যাস্ট্রিক-আলসার, ডিপ্রেশন, কিডনি পাথর, মূত্রনালিতে ইনফেকশন,কোমর ব্যথা, দাঁত ও মাড়ির ঘা, পাইলস, হৃদরোগ, রক্তচাপ, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং দুর্ঘটনা।

এদেশের আবহাওয়া আমাদের জন্য অনুকূল নয়;বিশেষ করে এখানে বছরের ৮/৯ মাস প্রচণ্ড গরম।গরমে তাপমাত্রা গড়ে ৩৮-৪৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসে উঠানামা করে।
এ সময় এরা পর্যাপ্ত পানি পান করে না।ফলে দেহে পানি শূন্যতা দেখা দেয়।
শাকসবজির দাম বেশি বলে এরা তা খায় না, আর যত্রতত্র শাক-সবজি পাওয়াও যায় না দেশের মতো।
যা পাওয়া যায় সেগুলো আমাদের ভালো লাগে না খেতে অভ্যস্ত নই বলে।
ফলমূল খায় না।
ভাজি-ভুনা বেশি খায়।
ফলে এসিডিটি,কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনিতে পাথর দেখা দেয়।
যেহেতু আঁশযুক্ত খাবার এদের খাদ্য তালিকায় কম থাকে, পাইলস্ হবার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
আর যারা দিনমজুর, ভারি কাজ করে তাদের অনেকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যথানাশক খেয়ে একসাথে নানান জটিলতায় ভোগে।
রোগী আসে তাদের সমস্যার কথা শুনি। অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের, যাদের সংসারে নানা ঝামেলা নিত্য সাথী।
মালিক পক্ষের সাথে বনিবনা হয় না, শ্রম বেঁচে পেট চলে না, পারিবারিক অশান্তি, সব মিলিয়ে ডিপ্রেশনে ভোগে এরা।
এরা মোটেও স্বাস্থ্য সচেতন নয়। তাই চেষ্টা করি, নিজের সাধ্যে যা পারি করি।

কথা শেষ করে বললেন, সাইফ ভাই শুক্রবারে একটা ইফতার এর দাওয়াত আছে চলেন যাই।
রাজি হয়ে গেলাম, যদি লেখার মতো কিছু পেয়ে যাই !

জায়গাটার নাম “ছানাইয়া”, আরবি শব্দ।
বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় শিল্প-এলাকা।
আগে আসা হয় নাই।
রাস্তার দু-পাশে সারি সারি দোকান, সাইনবোর্ড সব বাংলায় !
মাছের দোকান, সেলুন, রেস্তোরা, চা-দোকান, ঝালমুড়ি বিক্রি হবে, সব রেডি;আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজি, সমুচা, ছোলা-বুট, আর আমার মুখে লালা !
পুরো রোযা প্রায় চলে গেলো এমন খাবার চোখে পড়েনি !
মনে হয় পুরানো ঢাকার চকবাজারে ঢুকে পড়েছি !
লুঙ্গি পরে বাঙালিরা কি স্বচ্ছন্দে ঘুরছে!
আমার অদ্ভুত লাগে, লুঙ্গি আমি ভালো পরতে পারি না, কেবলই ভয় হয় এই বুঝি খুলে পড়ে যাবে।
ডুবাই-তে আইন করা হয়েছে প্রকাশ্যে লুঙ্গি পরে বের হওয়া যাবে না!
মনে মনে ভাবি আইনটা এখানে হলে মন্দ হতো না।

ঢুকে পড়লাম সরু গলি ধরে।
আমাদের পুরানো ঢাকার সূত্রাপুরের মতো, বেশিরভাগ বাসাবাড়ি পুরানো ধাঁচের।

তিন তালা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম, সিঁড়ির মুখে একজন ষাটোর্ধ বুড়ো পান নিয়ে বসে আছে।
১ টাকায় ৪টা পান কিনলাম।
আজ পান খাবো।
জর্দা, সুপুরি, চুন সব আছে।
বাঃ সস্তা তো !
ভেতরে ঢুকতে ধাক্কা খেলাম !
গোটা সিঁড়ি জুড়ে সিগারেটের ফেলে দেয়া অংশ,ডিসপোজেবল চায়ের গ্লাস, পানের পিক, দেয়াল জুড়ে চুন ঘষা,
চক দিয়ে প্রিয়জনের নাম লেখা, ”অমুক প্লাস অমুক”!
একজন দেখলাম অসাধারণ একটা কবিতা লিখে রেখেছে !

ছাদে উঠে গেলাম।
এদেশের ছাদ ৭/৮ ফুট উঁচু করে দেয়া হয় যাতে করে কেউ “পাশের বাড়ির ওই মেয়েটি বললো সেদিন এই” গাইবার সুযোগ না পায়।

আয়োজন শ’ দেড়েক লোকের। একজন বাংলাদেশী ঠিকাদার আয়োজন করেছেন।
তাঁর অধীনে কাজ করা শ্রমিক ছাড়াও অভ্যাগতদের মাঝে দুই একজন ক্ষমতাশালী লোক এসেছেন।
বাঙ্গালির চিরাচরিত নিয়ম মাফিক তারা বক্তব্য দিতে শুরু করলেন, দোয়া চাইলেন। অনেক কথা-ই শ্রমিকদের মনে হয়
মনঃ পূত হলো না !
তারা একে অপরের সাথে ঠেলা-ঠেলি শুরু করলো। ফিসফিসিয়ে কেউ কেউ বললো ইস্ নেতা রে !
তোরে আমরা চিনি না! দেশে মা বোন ভাত পায় না আর তুই চামচা হইছো !
চকি ভাঙ্গা কেইছ খাইছো, অমুকের গরু চুরি করছো, জুয়া খেলতা, পুলিশের ভয়ে পালাইয়া এই দেশে আইছো, দল বদলাইয়া সরকারি দলের নেতা হইছো !
আরেকজন বলে তুই ঠিকই কইছো। মোগো ট্যাহা কন্টাক্টরে ঠিকমত দেয় না, তিন মাস বাকি, চামচা গুলারে দেহো !

যাই হোক একজন ভদ্রলোক আমায় ডেকে নিয়ে সবার উদ্দেশে বললেন, এই ভাই প্রবাসীর সুখদুঃখ নিয়ে কিছু লিখছেন বলে শুনেছি,
আপনাদের যদি তাঁর উদ্দেশে কিছু বলার থাকে তাহলে এখানে এসে বলেন আমরা শুনি।
অনেকগুলো হাত উঠলো, একটা যুবকের হাত বেছে নিলাম, বললাম,"তুমি বলো।"

সে বললো,"বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক।
বিগত তত্বাবধায়ক সরকার সৌদি আরবের সাথে একটা ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল।
তত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বর্তমান সরকারের কাঁধে একই ভাবে ভর করে আছে।
সেটা থাকতেই পারে।
তবে আমরা দেখেছি বর্তমান সরকারের একটা মহল সৌদি আরবের প্রসঙ্গ আসলে-ই বিএনপি-জামাত সৃষ্ট কিম্বা অন্য কোন অজুহাত দেখিয়ে উদাসীন থাকে।
এটা কাম্য নয়।
চাই শক্তিশালী কূটনৈতিক উদ্যোগ।

ভারত কি করছে দেখেন,তাঁরা নাক কুঁচকে দুরে না সরে সম্ভাবনা গুলোকে পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে!
কিছুদিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সৌদি আরব সফর করে গেছেন।
দ্বি-পক্ষীয় অনেক চুক্তি হয়েছে যার অধিকাংশ ভারতের অনুকূলে গেছে।
নতুন নতুন ব্যবসার প্রসার ভারতের সামনে।
এমনিতে-ই ভারতীয় পণ্যে দেশটি ঠাঁসা।
আপনারা জানেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সৌদি সফরের সময় ৫ তারকা খচিত
হোটেলে রাত্রি যাপন না করে বাতহা নামক স্থানে ভারতীয় ব্যবসায়ী,প্রবাসীদের সাথে একত্রে রাত কাটিয়ে গেছেন।
ভাবুন তিনি কিভাবে সাধারণে মিশেছেন,কেন মিশেছেন!
নাক কুঁচকে তো একবারও বলেন নি, “আধমরাগুলো কি আমার স্ট্যাটাস এর?”
তাঁরা এলে ভারত-সৌদি বাণিজ্য সম্ভাবনা বাড়ে। আই.টি প্রকৌশল,তথ্য প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ে,শ্রম বাজার সমৃদ্ধ হয়।
আর আমাদের মন্ত্রী,সরকারী কর্ম-কর্তা এলে চামচা পরিবেষ্টিত থাকেন,ধানের শীষ,সোনার নৌকা,তরবারি উপঢৌকন নিয়ে বগল বাজাতে বাজাতে দেশে ফিরে যান!
তারা আমাদের কথা কবে ভাবেন?

আর এখানকার দূতাবাসে কর্মরতরা আমাদের কথা কবে ভেবেছেন !
দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আচরণ আর উদাসীনতার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর সংগ্রহে নামুন,দেখবেন তালিকাটা গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক অফ রেকর্ডে ঠাঁই পেয়ে যাবে !

গোটা ছাদ জুড়ে পিনপতন নিস্তব্ধতা,সবাই থ’ হয়ে বসে শুনছে।

এই বাঘা ছেলেটা এরই মাঝে আমাদের সবাইকে ছাপিয়ে গেছে !

মনে মনে ভাবি, সাধারণের মাঝে এমন কতো ছেলে মিশে আছে তোমাদের মাঝে না এলে বুঝতেই পারতাম না !

মনে মনে বলি হে যুবক আমরা পারিনি তোমাদের পারতেই হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন