জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১২

বিজয় দিবস: বঙ্গবন্ধু, মহান মুক্তিযুদ্ধ অতঃপর চার দশক ।

বিজয় দিবস: বঙ্গবন্ধু, মহান মুক্তিযুদ্ধ অতঃপর চার দশক ।



এক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান:
জন্ম ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মার্চ ১৭, ১৯২০।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে প্রথম গ্রেফতার হন ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ পরিদর্শন এবং তার সম্মানে প্রদত্ত
সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে কংগ্রেসিদের বাধাদানের অজুহাতে ৭ দিনের কারাবাস করেই তাঁর আগমন জানান দিয়েছিলেন!
সেই যে শুরু তারপর একে একে ১৯৪০-এ ,১৯৪৮-এ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে ৬৫ জন ছাত্রের সঙ্গে, একই সালের ১১-ই সেপ্টেম্বর জিন্নার মৃত্যুর পর বিশেষ ক্ষমতা আইনে,৩১ মার্চ ১৯৪৯ নুরুল আমিন সরকারের হাতে, ১৯৫০-এ ভুখা মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে প্রায় ২ বছর, ৩১শে মার্চ ১৯৫৫, ১৯৫৮ সালে ১৪ মাস, ১৯৬২ সালে ৬ মাস,১৯৬৪ সালে গ্রেফতার পরে মুক্তি লাভ। ৬৬ থেকে ৬৯ মাঝ খানে জামিনে বেরিয়ে (১৭-১-৬৮) আবার গ্রেফতার হওয়া এই মানুষটি ছিলেন বাঙালি জাতির স্থপতি, স্বপ্ন দ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর পূর্ব বাংলার প্রতি সীমাহীন বৈষম্যমূলক আচরণ, অর্থনীতি, শিক্ষা, কর্মসংস্থান
এক কথায় অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এর ন্যায্য অধিকার প্রদানের বদলে শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন সবার মনে অঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল।
জীবনের বেশিরভাগ সময় জেলে থেকে। দলের প্রয়োজনে সাধারণের পাশে থেকে মুজিব তখন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত!

দুই।
বজ্র কণ্ঠ, স্বাধীনতা সংগ্রাম:

একথা সবারই জানা যে ১৯৭০ এর গণপরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দলের প্রতি দেশের আপামর জনতা তাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে বিপুল ভোটে দিয়ে মুজিব কে নির্বাচিত করে, ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিমাদের টালবাহানা শুরু করে। সকল আলোচনার পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে ১৯৭১ এর ঐতিহাসিক ৭-এ মার্চে বিশাল জন সমুদ্রে গর্জে উঠেন তিনি,
"....কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।

.............এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"


'মাটি চাই, মানুষ নয়' নীতিতে বিশ্বাসী শাসকগোষ্ঠীর আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৭১ সনের মার্চ ২৫ তারিখে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনতার উপর রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম গণহত্যা চালায়।সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন পাক হানাদারদের হাতে।

মুক্তিকামী অসহায় মানুষ হতবিহবল হয়ে উদভ্রান্ত হয়ে শহর ছেড়ে পালাতে থাকে। এসময় ইপিআর, সেনাবাহিনীর সদস্যরা কমান্ড ভেঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথ বেছে নেয়।
অখ্যাত এক সৈনিক জেনারেল জিয়া চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
শুরু হয় ঘুরে দাঁড়ানো। মুক্তিযোদ্ধারা সংঘটিত হয়। অস্থায়ী মুজিব নগর সরকার গঠিত হয়।

লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়ে ডায়রিয়া, কলেরা, খাদ্য এবং চিকিৎসা সংকটে পড়ে। ভারতের কোলকাতা সহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-ছাত্রীরা গান গেয়ে চাঁদা তোলার ছবিও বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। লেয়ার লেভিন শরণার্থী শিবিরের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, "শরণার্থী শিবিরের দিকে দুর্গত মানুষের মিছিল। তাদের আর্তনাদ আমি এখনো শুনি। মানুষের গলিত লাশ কতবার চোখে পড়েছে, তা বলতে পারবো না। নির্যাতিত নারীদের স্থবির চোখ, শিশুর শ্যেনদৃষ্টি আমাকে হতবিহবল করে দিত। চারপাশে শকুন উড়ত, শকুন মানুষের গলিত লাশ খুঁড়ে খাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছে নিরীহ মানুষ, কারো অঙ্গ নেই, কেউ বা বেয়নেটের খোঁচায় আহত।"
মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভের অনেক পর ১৬ মে ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধী ভারতে বাংলাদেশী শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আসেন ।

দীর্ঘ নয় মাসের অগ্নি ঝরা, রক্ত ঝরা সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এদেশি হায়েনা রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। তারা লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা,ধর্ষণের মত ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ৩ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত, সম্ভ্রমহানি ঘটেছিল শুধু তাদেরই প্ররোচনায়!
মুক্তিযুদ্ধে যখন বাঙালিদের জয় নিশ্চিত ঠিক তখনই এরা বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করেছিল দেশের কৃতি সন্তানদের। তাদের উদ্দেশ্য ছল একটাই বাংলাদেশকে মেধা-শূন্য করা।
৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ সেদিন বৃথা যায়নি। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

তিন।
৭১-এর ঘাতক দালাল পর্ব:
১৯৭১ এর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু ৭১-এর ঘাতক দালাল এবং মানবতা বিরোধীদের বিচারের দুরূহ প্রয়াস নেন।
সেই সময় বিচার না করার পক্ষে আন্তর্জাতিক লবিং, পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের বিনিময়ে যুদ্ধাপরাধীদের তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
প্রায় ৩ লক্ষ ৪০ হাজার মানবতা-বিরোধী তখন ছাড়া পেয়ে যায়!

সেদিনের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে আজকের প্রজন্মের কাছে মুখোমুখি করবে তা যদি ওই সময়ের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করতেন তাহলে ঐ ঘোষণার পক্ষে তারা একমত হতেন কিনা তা জানতে ইচ্ছে করছে।

সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সমালোচনা করতে গিয়ে প্রয়াত শহিদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার বলেছিলেন, "আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোনো নেতা যুদ্ধে আপনজন হারাননি ফলে স্বজন হারানোর ব্যথা তাদের জানা ছিলনা, ঘাতকদের তারা সহজেই ক্ষমা করতে পেরেছিলেন।"

জবাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা হাসিনা বলেছিলেন, "সেই সময় প্রায় ৪ লাখ বাঙালি পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় ছিল, তাদের পরিবার এবং আত্মীয় স্বজন বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার জন্যে রাস্তায় নেমেছিল, বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিল। এই অবস্থায় ক্লেমেন্সি দেয়া হয়েছিল।"

চার।
মুজিব এবং তথা কথিত সিভিল সোসাইটি:

স্বাধীনতার পর অনেকেই অস্ত্র সমর্পণ না করে আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয়, আইনের শাসন প্রয়োগে ব্যর্থতা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত গোষ্ঠী, স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্ত,
অনাহারে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, পুঁজিবাদীদের আধিপত্য মুজিবকে অসহায় করে তুলেছিল নাকি তিনি নিজেই এসব সমস্যা সমাধানে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তা নিয়ে আজও বিতর্ক চলছে।
বিশিষ্ট লেখক মুনতাসীর মামুন "ইতিহাসের আলোয় শেখ মুজিবুর রহমান"-এ উল্লেখ করেন, "১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত অভাব, অনটন, অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা সবই ছিল।
কিন্তু এসবের মধ্যেও তীব্র হয়ে বেজেছিল যেটি, সেটি হচ্ছে নতুন এক অপমান। হঠাৎ দেখি সাড়ে সাত কোটির মধ্যে দেড় লাখ মাত্র মুক্তিযোদ্ধা! বাকি সব?
কেউ বলেননি তেমন করে কিন্তু একধরনের হীণমন্যতা বোধ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল আমাদের মধ্যে যারা ছিলাম দেশে। নিমিষেই মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে বিস্মৃত হলেন যে, আমরা না থাকলে গেরিলা যুদ্ধ হতনা। বিষয়টি আরো বেদনাদায়ক হয়ে উঠলো যখন দেখা গেল মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র, বিশেষ পুরস্কার( যে ফর্মেই হোক) বরাদ্দ হচ্ছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ যেন অপাংক্তেয় হয়ে গেল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে। এ টেনশন পরবর্তী কালে সৃষ্টি করেছে সিভিল সমাজে বিরোধের, উচিত ছিল রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন এবং তারা ছাড়া বাকি সবাইকে এক কাতার ভুক্ত করা............"


এই উচিত অনুচিতের মধ্যখানে থেকেই তিনি ভুল করে চলেছিলেন। বাকশাল গঠন, নিজেকে আজীবনের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা, চাটুকার-মোসাহেবের সংখ্যাধিক্য,দলীয় লোকদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, রক্ষী বাহিনী, লাল বাহিনী গঠন স্বাধীনতাবিরোধী, চক্রান্তকারীদের আরও উস্কে দিয়েছিল।
আজকেও তাঁরা থেমে নেই। অন্তরে আজও বিদ্বেষী। বাহিরে জয়বাংলা!

পাঁচ।
বিজয়ের চার দশক:
স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও মনে হাজার প্রশ্ন!
শোষণ-বঞ্চনার আদৌ অবসান হয়েছে কি? দুর্নীতি, স্বজন-প্রীতি লুট-পাট বন্ধ হয়েছে কি? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কি?
গণতন্ত্র তথা মৌলিক অধিকার সুসংহত হয়েছে কি? দেশে কি আদৌ গণতন্ত্র চর্চা হয়?
স্বনির্ভর জাতি হিসাবে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে কি? আত্মনির্ভরশীল জাতি, পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠেছি কি?
জনগণকে জিম্মি করে যারা অপ-রাজনীতির খেলায় মত্ত তারা কারা?
৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করে আমরা কি রকম স্বাধীনতা পেলাম?
বেকারত্ব নিরসন, বিনিয়োগ, শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রবৃদ্ধি কোন খাতে আমরা উন্নয়ন করেছি?
দেশের ভাগ্যহত সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে আমরা নিজেদের কতখানি উৎসর্গ করতে পেরেছি?

শেষ:
বঙ্গবন্ধু," আমি ফেরেশতা নই। শয়তান ও নই। আমি মানুষ। আমি ভুল করবই। আমি ভুল করলে আমার মনে রাখতে হবে, আই ক্যান রেক্টিফাই মাইসেলফ। আমি যদি রেক্টিফাই করতে পারি,সেখানেই আমার বাহাদুরি। আর যদি গোঁ ধরে বসে থাকি যে না আমি যেটা করেছি সেটাই ভালো- দ্যাট ক্যান্ট বি হিউমান বিইং ........"। মুনতাসীর মামুন- "ইতিহাসের আলোয় শেখ মুজিবুর রহমান"

পাদটীকা: বঙ্গবন্ধুর উক্তি থেকে আমার দেশের সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর জন্য শিক্ষণীয় কিছু আছে কি? আজ কোনো সমালোচনা নয়। কোনো বিতর্ক নয়। আসুন দেশ গঠনে আত্ম-নিবেশ করি। আমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে চাই।
০৬।১২।২০১১
বিজয় দিবসের ই-বই '১৯৭১' প্রকাশিত।
সূত্র: ছবি ইন্টারনেট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন